নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচনের প্রচার গতকাল শুক্রবার রাত ১২টায় শেষ হয়ে গেছে। আগামীকাল রবিবার ভোট। কিন্তু কেন্দ্রীয় নেতাদের চেষ্টার পরও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের বিভাজন দূর হয়নি। নির্বাচনী সভার মঞ্চে দেখা গেলেও নৌকার প্রার্থী সেলিনা হায়াত আইভীর পক্ষে মাঠে নামছেন না তাঁর বিরোধী নেতাকর্মীরা। ফলে ভোটের দিন দলের নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে থাকবেন কি না, তা নিয়ে দলে দুশ্চিন্তা রয়েছে। আইভীর নির্বাচন পরিচালনায় যুক্ত দলের একাধিক কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতা তাঁদের আশঙ্কার কথা জানান।

নারায়ণগঞ্জের স্থানীয় রাজনীতিতে ওসমান পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে। তাদের সঙ্গে মেয়র প্রার্থী সেলিনা হায়াত আইভীর বিরোধ বেশ পুরনো। সিটি করপোরেশনের নির্বাচনী এলাকা বন্দর, নারায়ণগঞ্জ সদর, সিদ্ধিরগঞ্জ ও ফতুল্লা থানার আংশিক এলাকা নিয়ে গঠিত। এই দুই আসনের সংসদ সদস্য হলেন দুই সহদোর শামীম ওসমান ও সেলিম ওসমান। তাঁদের সঙ্গে আইভীর দূরত্বে দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যেও বড় বিভাজন তৈরি হয়েছে। কেন্দ্রীয় নেতারা নির্বাচনের শুরু থেকে তা দূর করার চেষ্টা করেও সফল হননি। সংসদ সদস্য শামীম ওসমান কয়েক দিন আগে নৌকার পক্ষে মাঠে নামার ঘোষণা দিলেও আইভীর নাম মুখে নেননি। আইভীও এ নিয়ে বেশি আগ্রহ দেখাননি। সব মিলিয়ে এই বিভাজনের জন্য দুই পক্ষের দায় আছে বলে মনে করেন নেতাকর্মীরা।

ওয়ার্ডভিত্তিক নৌকার প্রার্থীর নির্বাচন সমন্বয়ের দায়িত্ব পাওয়া আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা  বলেন, ওয়ার্ডগুলোতে নৌকার পক্ষে মাঠে নামছেন না আইভীবিরোধী আওয়ামী লীগ নেতারা। এই নেতাদের কেউ আবার ওয়ার্ড কাউন্সিলর নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত।

নগরীর ১ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থী সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুজিবুর রহমানের ছেলে মাহমুদুর রহমান। তিনি ছেলের লাটিম প্রতীকের পক্ষে প্রচারে ব্যস্ত।

জানতে চাইলে ১ নম্বর ওয়ার্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য সানজিদা খানম বলেন, ১ নম্বর ওয়ার্ডে কিছু সমস্যা ছিল। তবে এখন পরিস্থিতি অনেকটাই ভালো।

সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইয়াছিন মিয়া ২ নম্বর ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর ইকবাল হোসেনের পক্ষে কাজ করছেন।

সিদ্ধিরগঞ্জ থানা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক শাহজালাল বাদল ৩ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থী। তিনিও নৌকার পক্ষে কাজ করছেন না। বিগত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এই ওয়ার্ডের প্রতিটি কেন্দ্রেই নৌকা পরাজিত হয়।

মাঠ ঘুরে দেখা গেছে, সংসদ সদস্য সেলিম ওসমানের ঘনিষ্ঠ বন্দর থানার চার ইউপি চেয়ারম্যান কাজ করছেন আইভীর প্রতিদ্বন্দ্বী তৈমূর আলম খন্দকারের পক্ষে। এই চার চেয়ারম্যান হলেন—বন্দর ইউপির এহসান চৌধুরী, কলাগাছিয়া ইউপির দেলোয়ার হোসেন, মুছাপুর ইউপির চেয়ারম্যান মাকসুদ হোসেন ও ধামগড় ইউপির কামাল হোসেন।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় একাধিক নেতা বলেন, মূলত দুই কারণে আইভী ও বিরোধীদের ভোটের মাঠে ঐক্য হচ্ছে না। প্রথমত, নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের অনুসারী আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে আইভীর দূরত্ব অনেক বেশি। এই দূরত্ব শুধু ভোটকে সামনে রেখে অবসান করা যাবে না। দ্বিতীয়ত, টানা দুই মেয়াদে মেয়র থাকায় দলের বাইরেও আইভীর নিজস্ব জনসমর্থন ও লোকবল তৈরি হয়েছে। তাঁর কর্মী-সমর্থকরাও শামীম ওসমানের অনুসারীদের সহ্য করতে পারে না। ফলে আইভীও কিছু ক্ষেত্রে চান না, শামীম ওসমানের অনুসারীরা তাঁর পক্ষে মাঠে নামুক।

দলীয় একটি সূত্র জানায়, সোনারগাঁ থানা যুবলীগের গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা আইভীর পক্ষে কাজ শুরু করেন। কিন্তু গত সপ্তাহে আইভী ওই যুবলীগ নেতাকে প্রকাশ্যে তাঁর পক্ষে মাঠে নামতে নিষেধ করেন। কারণ হিসেবে আইভী বলেন, হেফাজতের নেতারা ওই যুবলীগ নেতার মাঠে নামাটা পছন্দ করছেন না। ওই যুবলীগ নেতা বর্তমানে নিষ্ক্রিয় আছেন।

ভোটের মাঠে ঐক্যের ঘাটতি থাকলেও নৌকার প্রচারমঞ্চে আইভী ও বিরোধী নেতাদের একসঙ্গেই দেখা যাচ্ছে। গতকাল শুক্রবার নির্বাচনী প্রচারের শেষ দিন নৌকার পক্ষে যে শোভাযাত্রা হয়, সেখানে নারায়ণগঞ্জ ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা সবাই উপস্থিত ছিলেন।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, ‘আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা নৌকার জয়ের জন্য কাজ করছেন। আওয়ামী লীগের কোনো নেতাকর্মী নৌকার বিপক্ষে কাজ করবেন, এটা আমরা বিশ্বাস করি না।’

দলীয় কোন্দলের বিষয়টি মানতে রাজি নন শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠ নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক খোকন সাহা। তিনি বলেন, শামীম ওসমান সংবাদ সম্মেলন করে নৌকার পক্ষে দলীয় নেতাকর্মীদের কাজ করতে বলেছেন। এরপর দলীয় নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে নৌকার পক্ষে নেমেছেন।

ভোটের দিন থাকবেন কেন্দ্রীয় নেতারা : গতকাল রাত ৮টা থেকে দুই ঘণ্টা বৈঠক করেন নির্বাচন পরিচালনায় সম্পৃক্ত দলের কেন্দ্রীয় নেতারা। এতেও দলের বিভাজন নিয়ে আলোচনা হয়। বলা হয়, ওয়ার্ড পর্যায়ে দলের কমিটি না থাকায় দলকে ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নামানো যাচ্ছে না।

সভায় আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক ও আব্দুর রহমান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, চারজন সাংগঠনিক সম্পাদক এবং দলের প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত ১৬ কেন্দ্রীয় নেতা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে ভোটের দিন কেন্দ্রীয় নেতাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত ওয়ার্ডে অবস্থান করতে নির্দেশ দেওয়া হয়।

#কালের কণ্ঠ